মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১২ অপরাহ্ন
খাইরুল ইসলাম আল আমিন: প্রয়াত সমাজকল্যাণ প্রতিমিন্ত্রী প্রমোদ মানকিন এমপির ব্যক্তিণার সহকারী (পিএস) আব্দুর রহমান। টেন্ডার, নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি, পদোন্নতি, অনিয়ম, দুর্নীতিসহ অপকর্মের ফিরিস্ত দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক’র নজরে এসেছে একযুগ পরে। দুদক কর্তৃপক্ষকে অতি দ্রুত বিষয়টি খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন হালুয়াঘাটের সচেতন নাগরিকগণ। আব্দুর রহমান বিত্তহীন ঘড়িমিস্ত্রি থেকে কোটিপতি সংবাদটি দৈনিক ময়মনসিংহ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর হালুয়াঘাটের সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনার ঝড় সৃষ্টি হয়েছিল। হালুয়াঘাট উপজেলার হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেও এখন দামী গাড়ি- বাড়ি, শতশত বিঘা জমির মালিক ও বিদেশে পাচার করেছেন কোটি কোটি টাকা।
তবে এ টাকা তার নয় বলে দাবি করেছে আব্দুর রহমান। ময়মনসিংহ-১ আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত প্রমোদ মানকিনের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) আব্দুর রহমান। চলেন ভিআইপি স্টাইলে। দেখলে মনে হয় বাপ দাদা জমিদার ছিলেন। হতদরিদ্র ঘরের সন্তান আব্দুর রহমান। তদবীর ও নিয়োগ বাণিজ্য,দুর্নীতি অনিয়ম করে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। ভূমি জালিয়াতি, প্রতারণা, মিথ্যা মামলার রেকর্ড সৃষ্টি করে বিএনপি জামাতের নেতা-কর্মীদের হয়রানি করে জিরো থেকে হিরো হয়েছেন বহুরূপি আব্দুর রহমান। ছিল সামাণ্য ঘড়িমিস্ত্রি। দিন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থায় তখন তার সংসার চলতো। স্ত্রীর ভরণ পোষন যোগানোর সক্ষমতাও তার ছিলনা তার এমন দাবি আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসির। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হালুয়াঘাটের একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা প্রতিদিনের কাগজকে জানান, খুব শিগগিরই তার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকে মামলা হওয়া প্রয়োজন।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৩ সালের আগস্টে ভিজিএফ চাল ওজনে কম দেয়ায় দুস্তরা ও এলাকাবাসী ক্ষুদ্ধ হয়ে আব্দুর রহমানকে গণপিটুনি দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সরকারি বরাদ্দকৃত ঈদের বিশেষ ভিজিএফের চাল হালুয়াঘাট উপজেলা হলরুমে সকালে দুস্থদের মাঝে বিতরণ করা হয়। কিন্তু বিতরণের সময় ১০ কেজির স্থলে ৭/৮ কেজি করে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে উপজেলা সদরের বেপারীপাড়ার এক বৃদ্ধ রিকশা চালক চাল কম দেয়া নিয়ে। কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলে সেখানে দায়িত্বে থাকা আব্দুর রহমান তাকে চর থাপ্পর মেরে বের করে দেয়। ঘটনাটি এলাকায় জানাজানি হলে দুপুরে এলাকাবাসী লাঠিসোটা নিয়ে আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে জুতা ও ঝাড়ু মিছিল বের করে। পরে তারা উপজেলা হলরুম ঘেরাও করে। এক পর্যায়ে উত্তেজিত জনতা আব্দুর রহমানকে গণপিটুনি দেয়। এদিকে ২০১৭ সালে ময়মনসিংহ প্রতিদিনে তাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় হালুয়াঘাটের সর্বত্র চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। হকারের সকল পত্রিকা শেষ হয়ে যাওয়ায় সংবাদটি হাজার হাজার ফটোকপি করেছেন ভূক্তাভোগী ও আমজনতা। পূর্ববর্তী সংবাদটি পাঠকের অনুরোধে আবার সংযুক্ত করা হলো। আব্দুর রহমানের বাবা ছিলেন হত দরিদ্র তথা দিন মজুর শ্রেনীর। ১৯৯৬ সালের আগে টিনের ঘরে বসবাস করতেন।
হালুয়াঘাটের কাচারী রোডস্থ ভাড়ায় নেয়া ঘড়ি মেরামতের একটি দোকান, ছোট্ট একটি কুড়ে ঘর ছাড়া ছিলনা কোন জায়গা-জমি। সেই আব্দুর রহমানের দিনবদলের কাহিনি রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। অতীত আর বর্তমানের তফাতটা এক কথায় রাত আর দিন। ঘড়িরমিস্ত্রি থেকে বর্তমানে তিনি শত কোটি টাকার মালিক। বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ, সমাজ সেবক ও খ্রিস্টান ও গারো সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম সংসদ সদস্য ছিলেন প্রমোদ মানকিন। তিনি সম্প্রদায়ের বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়া মানবাধিকার কমিশনের সদস্য, আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সদস্য এবং খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান এবং ঘাতক- দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহ-১ আসন থেকে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রমোদ মানকিন এর বাসায় কাজ করতেন আব্দুর রহমান। প্রমোদ মানকিন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর আব্দুর রহমানকে বানিয়েছিলেন ব্যাক্তিগত সহকারী (পিএস)। এরপর আর পেছনে থাকাতে হয়নি আব্দুর রহমানের। জানা গেছে, অবৈধভাবে ঘুষের টাকায় দুবাই কিনেছেন বিলাসবহুল ফ্লাট ও বাড়ি। দুর্নীতির যেন শেষ নাই আব্দুর রহমানের। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকায় সবাই তাকে ব্যাংকের মালিক হিসাবে চিনে। সামান্য ঘড়িমিস্ত্রি থেকে শতকোটি টাকার মালিক আব্দুর রহমান। এখন হয়েছে প্রায় শত বিঘা জমির মালিকও। নিজ পরিবারসহ আত্মীয় স্বজনের নামে-বেনামে তার রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে হিসাব। প্রয়াত প্রমোদ মানকিন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী থাকায় সময় আব্দুর রহমান প্রভাব বিস্তার করে হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া সিমান্ত থেকে গাড়ি করে পাচার করা হতো মদ, ফেনসিডিল। গাড়ি তল্লাশি করায় ছিল না কোনো পুলিশের সাধ্য। এ সুবাদে প্রতিদিন সেই গাড়িতে পাচার করা হতো মাদক। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিপুল পরিমাণ মাদকসহ গাড়িটি আটক করে ময়মনসিংহের ডিবি পুলিশ। মন্ত্রীর এপিএস হওয়ায় পুলিশ বিষয়টি পাশ কাটিয়ে মামলাটি ভিন্নভাবে দায়ের করেন।
সাবেক এক ওসি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিদিনের কাগজকে জানান, ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) আব্দুর রহমান মাদক নিয়ন্ত্রণ করতো। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) আব্দুর রহমান সাবেক সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের ক্যাশিয়ার বলে ময়মনসিংহে ব্যাপক পরিচিতি ছিল। এ ছাড়াও হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া সিমান্তে সোনা পাচারের রয়েছে ব্যবসা। এ সোনা পাচারে তার পার্টনার রয়েছে কমপক্ষে ১০ জন ব্যাক্তি। তাদের সাথে রয়েছে সাবেক এক এমপির গভীর সম্পর্ক। জানা গেছে, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) থাকার সময়ে উপজেলার গাজীরভিটায় ৩০ বিঘা, বিলডোরা ১৫ বিঘা, ভুবনকুড়া ২০ বিঘা জমি ক্রয় করে এবং প্রচার আছে উত্তরা ও গুলশানে তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়াও ধারাবাজারে কোটি টাকার জমি ক্রয় করেন আব্দুর রহমান। তার ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। প্রতিবাদ করলে তার নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে পেটাতো। হয়রানি করতো মিথ্যা মামলা দিয়ে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, নিয়োগ বানিজ্য, পাথর, কয়লা, চিনি, জিরা, ভারতীয় কসমেটিক, শাড়ী ও মাদক বিক্রি করে প্রায় ১৫ বছরে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১২টি ট্রাকের মালিক আব্দুর রহমান। তখন প্রশাসন সবেই জানতো কিন্তু অসহায় ছিল। আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস ছিল না কারও। হালুয়াঘাট থানা-পুলিশ ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। এ ছাড়াও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পেতো না কেউ। প্রতিবাদ করলেই পুলিশ দিয়ে মিথ্যা,সাজানো মামলা দিয়ে হয়রানি করতো। আব্দুর রহমানসহ সাবেক সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের ১২জন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নামে দুদকে একটি অভিযোগ দায়ের করেন এক ব্যক্তি। প্রতিদিনের কাগজের অনুসন্ধানে জানা যায়, ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর আব্দুর রহমান ও পুলিশের সোর্স খোকা, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে সহায়তা করে। ইতিমধ্যে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া হয়ে অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার পথে সিনিয়র সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু, শ্যামল দত্তসহ চারজনকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয় জনতা। এরপর থেকেই আব্দুর রহমানের নাম প্রকাশ্যে আসে। স্থানীয়রা জানান, ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগের নেতারা আব্দুর রহমানের হাতধরেই ভারতে পারি জমিয়েছে। এই অভিযোগটি অনুসন্ধান চলছে বলে জানান দুদকের এক কর্মকর্তা।
এর আগেও রহস্যজনকভাবে দুদকে দায়ের করা একটি অভিযোগের তদন্তে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি ছিলনা। কিন্তু এবার সেই অভিযোগ আবারও দাখিল করেছেন আবুল খায়ের নামের এক ব্যাক্তি। এসব বিষয়ে আব্দুর রহমানের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার হোয়াটসএ্যাপ এ মেসেজ দিয়েও কোন সাড়া মিলেনি। স্থানীয় লোকজন জানান, ছাত্র-জনতা আন্দোলনের পর থেকে পলাতক রয়েছে আব্দুর রহমান। কিন্তু তার সহযোগীরা সিমান্ত দিয়ে এখনো মাদক ও অবৈধ জিনিষপত্র আমদানি করছেন। অভিযোগ রয়েছে আব্দুর রহমানের ব্যাক্তিগত ক্যাশিয়ার পুলিশের সোর্স খোকা প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তাদের অবৈধ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা সংস্থার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) শহিদুল ইসলাম জানান, আপনার কাছে প্রথম তার নাম শুনলাম। যা শুনেছি সত্য হলে তাকে গ্রেফতার করা হবে। হালুয়াঘাট থানার ওসি আবুল খায়ের জানান, অবৈধ পণ্য যারাই আমদানি করুক তাদের গ্রেফতার করা হবে।